ওয়ার্ল্ড বাংলা রিপোর্ট : দেশি-বিদেশি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ব্যাপক সমালোচনার পর জ্বালানি সম্পদ সমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশ কাতার আনুষ্ঠানিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শ্রম সংস্কারের সূচনা করেছে। এ সংস্কারের ফলে দেশটির অভিবাসী শ্রমিকদের যথাসময়ে বেতনপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে।
তবে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলো নতুন সংস্কার কর্মসূচির কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
কাতারের শ্রম সংস্কারের মূল বিষয় ‘দি ওয়েজ প্রটেকশন সিস্টেম’ (ডব্লিউপিএস)। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ২০২২ সালের ওয়ার্ল্ড কাপ আয়োজন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছেন এমন অভিবাসী শ্রমকিদের স্বার্থ রক্ষা, যাদের অনেকেই যথাসময়ে তাদের বেতন পান না। নতুন ব্যবস্থায় কর্মীরা পাক্ষিক ভিত্তিতে মাসে ২ বার অথবা মাসিক ভিত্তিতে বেতন পাবেন।
আর এ বেতন ‘ইলেকট্রনিক পেমেন্ট সিস্টেম’ এ শ্রমিকদের নিজ নিজ ব্যাংক হিসাবে পৌঁছে যাবে।
কায়িক শ্রম দেয় এমন শ্রমিকদের (ব্লু কলার ওয়ার্কার) যথাসময়ে বেতন পরিশোধে ব্যর্থতা নিয়ে উপসাগরীয় এ ধনী দেশটি সম্পর্কে মানবাধিকার গ্রুপের নানা সমালোচনা ও অভিযোগ রয়েছে।
ইতোপূর্বে ‘প্রোট্রেট অব লো ইনকাম মাইগ্রান্ডস ইন কনটেম্পোরারি কাতার’ শীর্ষক এক একাডেমিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এক পঞ্চমাংশ অভিবাসী শ্রমিকই কখনও কখনও অথবা কখনোই যথাসময়ে বেতন পায় না।
নতুন ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বেতন পরিশোধের জন্য নির্ধারিত রেয়াতী সময় গত ১৮ আগস্ট শেষ হয়েছে। ওই তারিখের পর থেকে যেসব কোম্পানি তাদের কর্মীদের যথাসময়ে ‘ইলেকট্রনিক পেমেন্ট সিস্টেম’ এ বেতন প্রদানে ব্যর্থ হবে, তাদেরকে ৬ হাজার কাতারি রিয়াল (১৬৫০ ডলার বা ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা) জরিমানা গুণতে হবে।
এ ছাড়া ব্যর্থ কোম্পানি নতুন কর্মী নিয়োগ দিতে পারবে না এবং এসব কোম্পানির কর্মকর্তাদেরকে জেলেও যেতে হতে পারে।
নতুন বিধিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয় পরিদর্শন টিম গঠন করেছে। যারা বিধিমালা পালন করছে না তাদেরকে চিহ্নিতও করা হচ্ছে।
দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয় ‘দি ওয়েজ প্রটেকশন সিস্টেম’ (ডব্লিউপিএস) তদারক করছে। কারণ ইতিপূর্বে একে কাতারের শ্রম সংস্কারের অঙ্গীকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
কাতারে বিশ্ব ফুটবলের বড় আয়োজনের ঘোষণার পর থেকেই দেশটির শ্রম ব্যবস্থার ক্ষুব্ধ সমালোচনার জবাব হিসেবেই গত মে মাসে শ্রম মন্ত্রণালয় ডব্লিউপিএসকে বিদ্যমান ব্যবস্থার তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এবং উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ইতোপূর্বে সংস্কারের শ্লথগতির সমালোচনা করলেও এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ডব্লিউপিএস-কে স্বাগত জানিয়েছে। নীতিগতভাবে একে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছে এমনেস্টির গালফ মাইগ্রান্ট রিসার্চার মুস্তফা কাদরী।
তবে মঙ্গলবারের সময়সীমা অতিক্রান্ত হবার পর কী হবে তা নিয়ে অবশ্য এমনেস্টির উদ্বেগ রয়েছে। সংস্থাটি দোহা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছে যেন নতুন করে আর রেয়াতী সময় বাড়ানো না হয় এবং ‘ডব্লিউপিএস’ যেন কঠোরভাবে প্রতিপালিত হয়।
এর আগে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত নিজেদের শ্রম আইনে বড় ধরনের সংস্কারের ঘোষণা দেয় ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ কাতার। ২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ কাতারে ২০ হাজার কোটি ডলারের অবকাঠামো নির্মাণের বিশাল নির্মাণযজ্ঞ চলছে।
২০১৩ সালে কাতারে বিদেশি কর্মীদের জীবনধারা নিয়ে প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়েছিল, দেশটিতে নির্বিচারে শ্রমশোষণ চলে। আধুনিক দাস হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছিল বিদেশিকর্মীদের।
মূলত এরপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তোপের মুখে কাতার সরকার। ফুটবলের বিশ্ব সংস্থা ফিফাও নড়েচড়ে বসে। শ্রম সংস্কারের মূল কারণ মনে করা হচ্ছে ফিফার মন রক্ষা করা।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ সংস্কারকে স্বাগত জানালেও বিতর্কিত ‘কাফালা’পদ্ধতি বাতিল না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন মহল থেকে এই পদ্ধতিকে আধুনিক দাসত্ব বলে মন্তব্য করে এটি বাতিলের দাবি করা হচ্ছিল। কাফালার কারণে একজন বিদেশি কর্মীর কর্মস্থল পরিবর্তন কিংবা কাতার ছেড়ে যাবার সুযোগ নিয়ন্ত্রণ করে তার নিয়োগকর্তা।
কাতার সরকারকে শ্রম বাজার সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। কাতার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রস্তাবিত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।
‘বিশ্ব প্রতিবেদন ২০১৫’ শীর্ষক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এইচআরডব্লিউ জানায়, নির্মাণ খাতে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দেশটির ওপর বিপুল আন্তর্জাতিক চাপ আসে। ফলে শ্রম বাজার সংস্কারে গত বছর কাতারের নেওয়া প্রস্তাবনা ছিল প্রশংসনীয়। এতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। তবে এর কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে।
প্রতিবেদনে অারও বলা হয়েছে, শ্রমিক নিয়োগে কাফালা ব্যবস্থা আংশিক সংশোধন করেছে কাতার। একই সঙ্গে পাসপোর্ট বাজেয়াপ্তকারীদের জরিমানা বাড়ানোর পাশাপাশি দেশ ত্যাগে ইচ্ছুক কর্মীদের জন্য ভিসা ব্যবস্থাও সহজ করা হয়েছে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী এগুলো বাস্তবায়িত হলেও শ্রমিকদের অধিকার ও জোরপূর্বক শ্রম থেকে রক্ষায় তা যথেষ্ট নয়।
সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা শাখার পরিচালক সারাহ লেহ হুইটসন বলেন, “শ্রমবাজারের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছে কাতার। ২০২২ বিশ্ব কাপ (ফুটবল) আয়োজকের অবস্থান থেকে সরাতে চাওয়া সমালোচনাকারীদের এ সংস্কারের বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপযুক্ত জবাব দেবে কাতার।”
এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদন অনুসারে, নির্যাতনের কারণে কর্মীকে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নিয়োগদাতা পরিবর্তনের অনুমোদন দিলে তা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তবে, প্রস্তাবিত সংস্কার কার্যক্রমগুলো অভিবাসী গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কিনা, তা এখন পর্যন্ত জানায়নি কাতার।
উল্লেখ্য, কাতার, সৌদি আরব, লেবানন, জর্ডান, বাহরাইন, ইরাক, কুয়েত, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে তদারক ও অভিবাসী শ্রমিকদের দেখভালের জন্য যে ব্যবস্থা চালু রয়েছে তাকে বলা হয় কাফালা সিস্টেম। একে ইংরেজিতে স্পন্সরশিপ সিস্টেমও বলা হয়। এই ব্যবস্থার অধীনে অদক্ষ সব শ্রমিকের কাজের জন্য প্রয়োজন হয় স্পন্সর। বিশেষ করে সেটা হতে পারে তাদের নিয়োগকারী। এ সব শ্রমিকের ভিসা ও তার আইনগত অবস্থানের জন্য দায়ী থাকে ওই নিয়োগকারী বা স্পন্সর। কিন্তু অনেক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের পাসপোর্ট তাদের কব্জায় নিয়ে নেয়। অনেক শ্রমিককে নির্যাতন করে। তারা যাতে আইনি ব্যবস্থা নিতে না পারেন সে জন্য তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেয় নিয়োগকারীরা। এসবের তীব্র সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক সব মানবাধিকার সংস্থা। দি ইকোনমিস্টের মতে, যদি এই কাফালা সিস্টেম পরিবর্তন বা সংস্কার না হয় তাহলে অভিবাসী শ্রমিকদের কোন উন্নতি হবে না।
২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ কাতারে বিদেশি শ্রমিকরা সেই কাজ পাওয়ার আশায় প্রতিদিনই কাতারে পাড়ি জমাচ্ছেন।
উল্লেখ্য, কাতার ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত রয়েছেন বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক। কাতারের শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতে, ১৬ লাখেরও বেশি বিদেশী শ্রমিক কাজ করেন কাতারে। এই সংখ্যা কাতারের স্থানীয় শ্রমিকের চেয়ে অনেক বেশি। গড়ে প্রতি একজন কাতারি শ্রমিকের বিপরীতে রয়েছেন ২০ জন অভিবাসী শ্রমিক। ফলে সেখানে শ্রমিকরা বিভিন্ন সময়ে নানা দুর্ভোগে ভুগছেন। অনেকে ভিটেবাড়ি বিক্রি করে উন্নত জীবনের আশায় কাতারে পাড়ি দিচ্ছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখতে পাচ্ছেন সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন নামে শ্রম অধিকার বিষয়ক এক সংস্থা বলছে, নিয়োগকারীরা কাজ দেয়ার জন্য শ্রমিকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দাবি করে। তাদের বেতন আটকে রাখে। পাসপোর্ট নিয়ে নেয়। শারীরিক বা যৌন নির্যাতন করে।